ক্লাইম্যাক্স
গত বছর ঠিক আজকের দিনটাও ছিলো একটা রবিবার আর আমার অফিসের সাপ্তাহিক ছুটি। নিয়মিত ছুটির দিনের মতো সেদিনও গভীর রাত জাগা। ঘুমোতে ঘুমোতে প্রায় ৩ টা বাজলো। মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টা ঘুমোলাম এবং এরপরই আম্মু এসে জোরে আওয়াজ করে ঠেলে ঘুম দিয়ে উঠাচ্ছে আর বলছে "সাব্বির তাড়াতাড়ি ওঠ...আজাদ নাকি হাসপাতালে, মনে হয় আর নাই"
কাঁচা ঘুমের মধ্যে বুঝে উঠতে পারছি না কি শুনলাম।মনে হলো ঘুমের মধ্যে ভুলভাল শুনলাম। এর মধ্যেই আব্বুর ফোনে একের পর এক ফোন আর আব্বু প্রচন্ড অস্থির হয়ে বলছে "আমি রওয়ানা দিচ্ছি হাসপাতালের দিকে"। আব্বুর কন্ঠে প্রচন্ড হতাশা আর বেদনার ছাপ। আমি বিছানা থেকে উঠেই ওপাশে গিয়ে দেখি সবাই অস্থির হয়ে আছে। তার মানে ঘুমের মধ্যে যা শুনলাম তা একবারে সত্যি। কোনো রকম রেডি হয়েই আব্বু আর আম্মুকে নিয়ে বাড্ডার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। যাবার সময় বারবার দেখি আব্বুর হাহাকার আর্তনাদ আর আম্মুর আবেগ একদিকে কোনো রকম আবেগ চাপা দিয়ে আব্বুকে সামলানোর চেষ্টা। আব্বু একজন হার্টের রোগী হয়ে জানিনা কতখানি কষ্ট হচ্ছিলো লোকটার দূর্বল হৃদযন্ত্রে এতো বড় বোঝার ভার সইবার। একের পর এক ফোন আব্বুর কাছে আসছে তো আব্বু কাউকে ফোন দিচ্ছে। যাবার পথেই ছোট কাকা ফোন দিয়ে বললো আজাদ ভাইয়াকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। মাত্র ২৬-২৭ বছর বয়সেই নিজের ভাগ্নের মৃত্যু আব্বুর অসুস্থ হৃদয়ে যেন নতুন কোন অসুস্থতা। হাসপাতাল না গিয়ে চলে গেলাম বাসার দিকে। একটু সামনে গিয়েই দেখি এম্বুলেন্স দাঁড় করানো ভেতরে ছোট কাকা বসে আছেন আজাদ ভাইয়ার মৃতদেহ নিয়ে। এম্বুলেন্সে ঢুকে বসলাম আমি,আব্বু আর আম্মু আর তিনজনেই সেই লোকটাকে সামনে দেখে কাঁদছি যাকে মাত্র ১৫-১৬ দিন আগেও পুরোপুরি সুস্থ দেখলাম। মাত্র ৩-৪ দিন আগেও আব্বুর সাথে অফিসে এসে দেখা করে গেছে। ৪ বছর প্রায় নিজের বড় বোনকে হারানোর পর এদিন বড় বোনের একমাত্র ছেলেকে এভাবে লাশ হতে দেখে আব্বু খুব অস্থির হয়ে যেতে শুরু করলো।
আমি কখনো কোনো মৃতদেহকে গোসল করাইনি তাছাড়া আমার এতো সাহসও নাই। এবার সেটাও করে ফেললাম। তিন বোনের একমাত্র ছোট ভাই এভাবে নিরুদ্দেশ যাওয়াটা ওদিন মানতে পারছিলাম না। মাত্র দু'তিন মাস আগেই আজাদ ভাইয়ার বড় বোন কনক আপুর মেয়ে যখন ওর আম্মুর ফেইসবুক আইডি থেকে ম্যাসেজ দিয়ে বললো "মামা তুমি তো আমাদের ভুলেই গেছো" তখন অফিসের ডেস্কে বসেই দু'চার ফোটা অশ্রু ঝরে পরলো।
এখন আজাদ ভাইয়া ছাড়া তার তিন বোন ভাইশূন্য, তাদের ছেলে-মেয়েদের একমাত্র মামাও আর রইলো না আর অন্যদিকে ফুপাতো ফুপিকে হারালো,তারপর ছেলেকে হারালো আর সব মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। তার বিশাল রাজপ্রাসাদে তিনি শেষ বয়সে সব থাকতেও কিছুই নেই যার এমন একজন অসুখী রাজা।
দু'মাস আগে লোকটা বাসায় বেড়াতে এসে যখন দেখলো তার জন্য আম্মু অনেক রকমের খাবার করেছে সেদিনও লোকটা খাবার প্লেটকে সামনে রেখেই কান্না করলো। জীবন প্রচন্ড বৈচিত্র্যময় যেখানে একটা জটিল ক্লাইম্যাক্স সবকিছু পরিবর্তন করে দেয়। ভালোর দিকে গেলে তো ভালোই আর খারাপের দিকে গেলেও এর থেকে খারাপ বোধহয় হতে পারে না।
আল্লাহ আজাদ ভাইয়াকে ওপর তলায় ভালো রাখুক এবং তাকে জান্নাতি করুক। আমিন।
Comments
Post a Comment